ফ্লোর প্রাইস দীর্ঘ মেয়াদে টিকবে কি? (১৪ টি পয়েন্ট বিশ্লেষন)


বাংলাদেশের শেয়ার বাজারে ফ্লোর প্রাইস ঠিক করে দেওয়া হয়েছিল একটি আপদকালীন রক্ষা কবজ হিসাবে। শেয়ারের অব্যাহত দরপতন ঠেকাতে আপদকালীন ব্যবস্থা হিসাবে প্রতিটি শেয়ারের দামের সর্বনিম্ন মুল্য নির্ধারন করে দেওয়া হয়েছিল ১৯ মার্চ, ২০২০ থেকে। কিন্তু এর পর থেকে শেয়ারের ক্রেতা সংকট দেখা দিতে থাকে এবং লেনদেন অব্যাহতভাবে কমতে থাকে। এর ভিতর, আস্তে আস্তে, দেশে কোভিড-১৯ (করোনাভাইরাস) এর প্রভাব বাড়তে থাকে। এমতাবস্থায় প্রশ্ন উঠছে ফ্লোর প্রাইস থাকা উচিত কিনা। আমরা যদি যুক্তির দিক থেকে চিন্তা করি তাহলে ফ্লোর প্রাইস থাকার পক্ষে এবং বিপক্ষে ১৪ টি গুরুত্বপুর্ন পয়েন্ট নিয়ে আলোচনা করা যায়। এই পয়েন্ট গুলোর ভিত্তিতে আমরা একটা ধারনা পেতে পারি যে ফ্লোর প্রাইস দীর্ঘ মেয়াদে টিকবে কিনা।   

ফ্লোর প্রাইসের পক্ষের যুক্তি

১। বর্তমানে ফ্লোর প্রাইস তুলে দিলে, যারা মার্জিন ঋণ নিয়ে শেয়ার কিনেছেন তারা, শেয়ারের দাম কমে গেলে, ফোর্স সেলের শিকার হতে পারেন। এতে করে মার্জিন ঋণ নিয়ে যারা শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করেছেন তারা ব্যাপক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন।  

২। যারা নিজেদের উদ্বৃত্ত অর্থ শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করেছেন তারা অনেকে ফ্লোর প্রাইস থাকাটা বেশি শ্রেয় মনে করেন। তাদের মতামত, দেশের অর্থনীতির সংকট কেটে গেলে, শেয়ার বাজার এমনি এমনি নিজের শক্তিতে ঘুরে দাঁড়াবে। সেই জন্য যদি একটু অপেক্ষা করতেও হয় তাহলে অপেক্ষা করাই শ্রেয়। অযথা শেয়ার বাজারে এখন দরপতনের ফলে আতংক সৃষ্টি হোক সেইটা তারা চান না।      

ফ্লোর প্রাইসের বিপক্ষের যুক্তি  

১। ব্লক মার্কেটে ফ্লোর প্রাইসের শর্ত শিথিল করা হয়েছে। বর্তমানে ব্লক মার্কেটে, রেগুলার মার্কেটের ফ্লোর প্রাইসের সর্বোচ্চ ১০% পর্যন্ত কম দামে শেয়ার কেনা বেচা করা যাবে। যেহেতু যে কেউ, ব্লক মার্কেটে ৫ লক্ষ টাকা বা তার উপরের মুল্যের শেয়ার কেনা বেচা করতে পারবেন, সেই জন্য বর্তমান যেই ফ্লোর প্রাইস, সেইটার খুব বেশি যথার্থতা থাকে না।  

২। অনেকেই মার্জিন ঋণের সুদের ব্যয় কমানোর জন্য কিছু শেয়ার বিক্রি করে নিজেদের কিছু মার্জিন ঋণ এডজাষ্ট করতে চান। কিন্তু যেহেতু শেয়ারের ফ্লোর প্রাইস থাকার কারনে লেনদেন খুব কম হচ্ছে, সেই জন্য চাইলেও শেয়ার বিক্রি করা যাচ্ছে না। যার ফলে মার্জিন ঋণের সুদের ব্যয় ক্রমাগত বেড়ে যাচ্ছে। যতদিন যাবে, তত সুদের ব্যয় বাড়তেই থাকবে।    

৩। কোভিড-১৯ (করোনাভাইরাস) এর কারনে অনেকেরই আয় কমেছে। যারা ব্যবসা করেন, তাদের অনেকেরই ব্যবসাতে মন্দা। যারা চাকুরী করেন, তাদের কেউ কেউ বেতন ঠিক মত পাচ্ছেন না বা বেতন কমিয়ে যেওয়া হচ্ছে। অনেকেরই অসুস্থতার জন্যও টাকা প্রয়োজন হতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে, যারা নিজেদের সঞ্চয় শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করে রেখেছেন তারা জরুরি প্রয়োজনেও শেয়ার বাজার থেকে তাদের টাকা তুলতে পারছেন না ফ্লোর প্রাইস থাকার ফলে লেনদেন কম থাকার কারনে।        

৪। শেয়ারে ফ্লোর প্রাইস থাকার কারনে লেনদেন কমে যাওয়ায় ব্রোকারেজ হাউজগুলো সংকটে পড়েছে যেহেতু তাদের আয়ের প্রধান উৎস ব্রোকারেজ কমিশন। অনেক ব্রোকারেজ হাউজ এখন ব্রেক-ইভেন লেভেলেও আসতে পাড়ছে না যার ফলে তাদের আর্থিক ক্ষতির পরিমান বাড়ছে।  

৫। শেয়ার বাজারে মুলত ২ ধরনের মিউচুয়াল ফান্ড আছে। একটি হচ্ছে ক্লোজ-এন্ড মিউচুয়াল ফান্ড যেটি শেয়ার বাজারে লেনদেন হয়; আরেকটি হচ্ছে ওপেন-এন্ড মিউচুয়াল ফান্ড যেটি শেয়ার বাজারে লেনদেন হয় না। ওপেন-এন্ড মিউচুয়াল ফান্ড কিনতে বা বিক্রি করতে চাইলে এসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি (মিউচুয়াল ফান্ডগুলোর ম্যানেজার) এবং তাদের মনোনীত সেলিং এজেন্টের মাধ্যমে করতে হয়। যদি কেউ তার হাতে থাকা মিউচুয়াল ফান্ডের ইউনিট বিক্রি করতে চান তাহলে অনেক ক্ষেত্রেই এসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিকে উক্ত মিউচুয়াল ফান্ডের পোর্টফোলিও থেকে কিছু শেয়ার বিক্রি করে গ্রাহকের টাকা পরিশোধ করতে হয়। শেয়ারে ফ্লোর প্রাইস থাকার কারনে লেনদেন কমে যাওয়ায় এসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিগুলোকে শেয়ার বিক্রিতে অসুবিধায় পরতে হতে পারে, যার ফলে মিউচুয়াল ফান্ডের গ্রাহক তার টাকা তুলতে সমস্যায় পরতে পারেন। এছাড়ায়ও মিউচুয়াল ফান্ড গুলো সাধারনত আইনগত নির্দেশনা মেনে বছরে ৪ বার (মার্চ, জুন, সেপ্টেম্বর, ডিসেম্বর) মিউচুয়াল ফান্ডের ম্যানেজমেন্ট ফি চার্জ করে এবং কেটে নেয়। এই ম্যানেজমেন্ট ফি নেওয়ার জন্যও শেয়ার বিক্রি করার দরকার হতে পারে। কিন্তু ফ্লোর প্রাইস থাকার কারনে ক্রেতা না থাকায় শেয়ার বিক্রি করার প্রয়োজন হলেও সেইটা করা যাবে না।

৬। মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো বিভিন্ন ধরনের পোর্টফোলিও ম্যানেজমেন্ট সার্ভিস দিয়ে থাকে যার বিপরীতে মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো ম্যানেজমেন্ট ফি চার্জ করে। এই ম্যানেজমেন্ট ফি নেওয়ার জন্যও অনেক ক্ষেত্রেই শেয়ার বিক্রি করার দরকার হতে পারে। কিন্তু ফ্লোর প্রাইস থাকার কারনে ক্রেতা না থাকায় শেয়ার বিক্রি করার প্রয়োজন হলেও সেইটা করা যাবে না।

৭। বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদের কারও কারও বিভিন্ন কারনে টাকা উঠানোর দরকার হতে পারে। কিন্তু ক্রেতা না থাকায়, প্রয়োজন হলেও তারা শেয়ার বিক্রি করে টাকা তুলতে পারবে না।   

৮। ফ্লোর প্রাইস থাকার কারনে এবং লম্বা সময় শেয়ার বাজার বন্ধ থাকার কারনে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের শেয়ার বাজারের ভাবমুর্তি সংকট দেখা দিয়েছে। এই ভাবমুর্তি সংকটের ফলে ভবিষ্যতে বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশের শেয়ার বাজারে আকৃষ্ট করতে অনেক বেগ পেতে হবে।

৯। বাংলাদেশের শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত কিছু কোম্পানির শেয়ার কিছু আন্তর্জাতিক ইনডেক্সে (i.e MSCI) তালিকাভুক্ত আছে। কিন্তু ফ্লোর প্রাইস থাকার কারনে শেয়ারের দাম বাজার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্ধারিত হচ্ছে না। এতে করে আন্তর্জাতিক ইনডেক্স থেকে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের কোম্পানির শেয়ারকে অপসারণ করার ঝুকি দেখা দিয়েছে।     

১০। শেয়ার বাজারে যদি তারল্য না থাকে তাহলে নতুন বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা খুবই কঠিন। কেউ চান না তার কষ্টার্জিত অর্থ কোন বিনিয়োগের জায়গায় আটকে যাক।

১১। শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ কোন অত্যাবশ্যক পন্য নয়। চাল, ডাল যেমন অত্যাবশ্যক পন্য। চাল, ডালের দাম বেড়ে গেলেও মানুষ বেশি দাম দিয়েও ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও কিনবে। কিন্তু শেয়ার বাজারে বিনিয়োগের ব্যাপারটা এমন নয়। কারও হাতে টাকা থাকলে সে ব্যাংকে টাকা রাখতে পারে, জমি বা ফ্ল্যাটে বিনিয়োগ করতে পারে, সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করতে পারে, স্বর্নে বিনিয়োগ করতে পারে কিংবা হাতে নগদ টাকা রাখতে পারে। যেহেতু শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ কোন অত্যাবশ্যক পন্য নয় তাই হাতে টাকা থাকলেও কেউ শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করতে বাধ্য নয়।  

১২। অনেকের হাতে টাকা থাকতে পারে যারা হয়ত শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী। কিন্তু ফ্লোর প্রাইস থাকার কারনে শেয়ার বাজার যেহেতু তার গুনগত বৈশিষ্টের উপর ভিত্তি করে উঠানামা করছে না তাই হয়ত অনেকেই অনিশ্চয়তার কারনে হাতে টাকা থাকার পরেও বিনিয়োগ করছেন না।

শেয়ার বাজারে ফ্লোর প্রাইস থাকার পক্ষের এবং বিপক্ষের মোট ১৪ টি গুরুত্বপুর্ন যুক্তির উপর ভিত্তি করে একটা ধারনা করা যায় যে, ফ্লোর প্রাইস হয়ত কিছু দিন টিকবে, তবে সেটি দীর্ঘমেয়াদী হবে না। তবে ফ্লোর প্রাইস থাকুক কিংবা না থাকুক যেই সকল কোম্পানির ব্যবসা ভাল হবে, সেই কোম্পানিগুলোর শেয়ারর দাম নিশ্চয়ই বাড়বে। আর কোন কোম্পানির ব্যবসা যদি খারাপ হতে থাকে তাহলে যতদিনই ফ্লোর প্রাইস থাকুক না কেন তা থেকে ওই কোম্পানির শেয়ারের দামে কোন ইতিবাচক প্রভাব পড়বে না। 

#Floor #Price #Sustainability #Long #Term #Finance #School #BD #Bangladesh #Bangla #DSEBD #DSE #CSE #CSEBD

Written By: Md. Shihab Alam Khan (মোঃ শিহাব আলম খান)

Youtube Channel Link: https://www.youtube.com/financeschool      

Facebook Page Link: https://www.facebook.com/fsclbd    

Facebook Profile Link: https://www.facebook.com/Shihab.Alam.Khan 

Post a Comment

0 Comments